

খোন্দকার জিল্লুর রহমান :
সরকার যখন দেশের জনগনের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক্ত আমলাদের গাড়িসুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যপক খরচসহ, চালকের বেতন ও গৃহকর্মীর ভাতা পর্যন্ত প্রদান করে, তখন তাঁদের প্রকৃত মজুরি আর্থিক মজুরিকে ব্যাপকভাবে অগ্রাহ্য করা হয় বলে প্রতিয়মান। এ বিষয়টা একদিকে যেমন দেশপ্রেমের অন্তরায় অপরদিকে গরিবের ঘোড়ারোগ বলে ধরা যায়।
আমলারা আবার এই গাড়ি যখন সরকারের অফিসবহির্ভূত কাজ, যেমন দৈনন্দিন বাজার করা, সন্তানদের স্কুল কলেজে যাতায়াত, বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গমনাগমন, এমনকি প্রিয়জনের প্রয়োজনেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তখন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে প্রকৃত মজুরি আরও অনেক বেড়ে যায়। তারপর যদি মাসে ভাতাসহ কয়েকটি মিটিং থাকে, তখন এসব আমলাদের প্রকৃত মজুরি আরো অনেক বাড়িয়ে দেয়, এ ব্যাপারে কেহ কেহ বলেন, বেতনভুক্ত থাকার পরে আবার ভাতা কেন, সবইতো সরকারি কাজেরই অংশবিশেষ। অথচ দেখা যায় এ রকম আমলা, প্রকৌশলী, শিক্ষক, লেখকসহ দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিকরার কারিগর, অর্থ্যাৎ আমলাদের চেয়েও বেশি অবদান যাদের তাদের জীবনযাপনের জন্য সরকারের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ নয়কি?
যেমন, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও বুয়েটের ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষক যদি একটা মিনিবাসে করে বহুদুর দুরান্ত থেকে তাঁদের নিজ নিজ ক্যাম্পাসে বা কর্মস্থলে আসতে পারেন, তাহলে আমলাদের একই রকম বাসে করে অফিসে যাতায়াতে সমস্যা কোথায়? আবার ঢাকা মেডিকেলের একজন ডাক্তারকে যদি ৫/৭দিন আগে রিকুইজিশন দিয়ে একটা গাড়ি পেতে হয়, আর সে রকম যোগ্যতার একই ডাক্তার যখন কোনো বাহিনীতে চাকরি করে, তাঁর জন্য দুটি গাড়ি নিয়মিত বরাদ্দ থাকে, তাহলে ঢাকা মেডিকেলসহ এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের থেকে ভালো সেবা দেশের নাগরিকদের জন্য আশা করা যায় না। আমলাদেরও গাড়িকে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে না দেখে প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করলে বেতন-বৈষম্যের উৎসও কমে যাবে। বড় গাড়ি মানে বেশি মর্যাদা, বেশি ক্ষমতা এ নিচুতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এইসব বাড়তি মজুরি এবং সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে ক্রমান্বয়ে তৈরি হয় ক্ষমতার অনৈতিক, অপব্যবহারসহ আরো পাওয়ার আকাঙ্খা, সম্প্রতি পালিয়ে যাওয়া সরকারের ১৭ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমানিত, রাজনীতিকদের অদুরদর্শিতা, আজীবন ক্ষমতায় থাকার অদম্য আকাক্সক্ষা, আমলাদেরকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজের আদলে তৈরি করা, দেশপ্রেমের অভাব, সর্বক্ষেত্রে যোগ্যদের বাদ দিয়ে সুপারিশে অযোগ্যদের নিয়োগ, ঘুষ, দুর্নীতিতে সহঅবস্থানকে ভারসাম্যহীন করে রেখেছে। বর্তমানে এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ডাক্তার ও প্রকৌশলীরাও কম এগিয়ে নয়, দেশপ্রেম তাদের নিকট মুল্যহীন, সর্বক্ষেত্রে সুপারিশ বন্ধ করা, সুপারিশ গ্রাহক, সুপারিশকারী ও সুপারিশ গ্রহীতা সবাইকে নিষিদ্ধ, শুদ্ধাচার চর্চা, যেকোন ক্রাইমের তড়িৎ বিচার এবং রায় কার্যকর ব্যবস্থা দুর্নীতি তো করছেই সেইসাথে নাগরিক মুল্যবোধ এবং বিশ্বদরবারে জাতিগত অবস্থানকেও তলানিতে নিয়ে যায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমানো গেলে বিসিএসের কয়েকটি ক্যাডারের প্রতি যে সীমাহীন মোহ এবং প্রতিযোগিতা, তা অনেকটাই কমে আসবে। এসব ক্যাডার চাকরির বাজারে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে, তাও অনেকটা কমে যাবে। অতিরিক্ত টাকা কামানোর নেশা, লোভ, লালসা, অহঙ্কার, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং অতি বিলাসিতা ক্রমেই মানুষকে নির্বোধ বিবেকহীন এবং দেশপ্রেমের অন্তরায় হিসেবে তৈরি করে। একইসাথে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের অদূরদর্শীতা একটি কল্যান রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত করে। প্রজাতন্ত্রের ১৮ কোটি মানুষ এর থেকে পরিত্রান প্রত্যাশা করে….