সন্তানকে আশাবাদী করা বাবা-মার দায়িত্ব

খোন্দকার জিল্লুর রহমান :
লাস্ট বেঞ্চে বসতে পারা ছাত্রটা যদি সারা বিশ্বের সেরা একটা কিছু হয় আমি একটু অবাক হবো না। লাস্ট বেঞ্চে বসতে পারা ছেলেটা সবার নিকট লেখাপড়ায় খারাপ, পরিক্ষায় রেজাল্ট অনেক ভালো না করা ছেলেটা, এমনকি বাবা-মায়ের চাহিদার রেজাল্ট না করা ছেলেটাকে বাবা-মাও তিরস্কার করে, খাওয়া-দাওয়া দিতে চায় না টিভি দেখতে দেয় না, সাথে মন খুলে কথা বলতে এবং আড্ডা দিতে দেয় না, একটু আদর-স্নেহ দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে মনখুলে দুটি কথা নিজেরাও বলেনা সন্তানকেও বলতে দেওয়া হয়না, বুঝাতে দেওয়া হয়না। সেই সাথে তাকে যে টিচারের নিকট পড়িয়েছে, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পড়াতে না করে দিয়ে অশ্লীল ভাষায় টিচারকে অপমান করাতো আজ কাল মামুলি ব্যাপার, এটাও করতে ছাড়ে না। যান্ত্রিক মানুষ হিসেবে আমরা শুধু আমাদের কাজটাই করে যাই, শুধু টাকার পেছনে দৌড়াতে থাকি, প্রাচুর্যের পেছনে দৌড়াতে থাকি, আর এদিকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার বিনিময়ে সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্বভার একজন টিচারের উপর ছেড়ে দেই, সন্তানের দেখাশোনার ভার ছেড়ে দেই অন্য একজন পেটের দায়ে টাকার বিনিময়ে আমাদের বাসায় শ্রম দেওয়া পুরুষ অথবা মহিলার উপরে। আমরা আমাদের উক্ত দায়-দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে দিয়ে আকাশচুম্বি ফলাফল পাওয়ার আশা ছাড়া অন্য কিছু কি আকাঙ্খা রাখি?? এ প্লাস না পাওয়া ছেলেটা বা মেয়েটাকে যেন একটা অকৃতকার্য, মেধাহীন অকর্মন্য হিসেবে অবমূল্যায়ন করি। কিন্তু কেন… আমরা দেখি আমাদের প্রতিবেশী বা আমাদের নিকটাত্মীয় আমাকে কি বলল বা কি তুলনা করল-না করল, অত টাকা পয়সার দিয়ে সন্তানকে ভালো টিচার দিয়ে পড়িয়েও এ প্লাস পেল না। আমার সন্তান প্রাইভেট না পড়েও এ প্লাস পেয়েছে। মেধাতো শয়তানেরও আছে, আমরা একটুও ভাবি না আমার/আমাদের মেধা কম কাজে লাগানো সন্তানটা বুঝতে চাই না তার মন কি চায় স্বাধীনভাবে। অনেক বিষয়ে কম মেধা খাটানো সন্তানও যে একটু আশা প্রত্যাশার কারণে অনেক ভালো কিছু করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে, হোক না সেটা যে কোন বিষয়ে, তা হোক শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, আবিষ্কারে, কৃষিকাজে, পশুপালনে, এমনকি মানবতার মূল্যায়ন সহ আত্মবিশ্বাসে। আমরা বাবা মায়েরা সাময়িক প্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় সন্তানের বাকি জীবনের সমস্ত সাফল্যকে ধুলোয় মিশে দেই। ক্রোধের কারনে সন্তানকে ওয়েস্ট, গার্বেজ, অযোগ্য বলে সন্তানের সামনে শিক্ষককেও অপমান করি।

এই খবরটুকু রাখি না যে, প্রতি বছর এইসব কারনে কতগুলো ছাত্র-ছাত্রী বাবা-মায়ের অপ্রত্যাশিত চাপ, তিরস্কার, অপমান ও ফিজিক্যাল টর্চারের কারণে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করে। আমরা কখনো জানতে চাইনা আমাদের সন্তান কেন ৭/৮ বিষয়ে ফেল করল বা আবার কোন কারনে এবং কিসের প্রত্যাশায় সকল বিষয়ে ভাল রেজাল্ট করল। হয়তো একটু অনুেপ্ররনা, প্রাপ্তি বা একটু প্রত্যাশা। গভীরভাবে একটুও চিন্তা করে দেখিনা, এ প্লাস পাওয়াই কি জীবনের সবকিছু!! কোন দুর্ঘটনার পর আমরা তখন এর বিশেষ কারণ খোঁজার চেষ্টা করে করে নিজের কাছে নিজেরাই হতাশ হই এটা ভুল ছিল, ওটা ভুল ছিল, ওটা করা উচিত ছিল না বা ওটা করা উচিত ছিল না। আমরা কখনো সন্তানদের জানতে চাই না কি করতে চায় ওরা বা কি করতে ইচ্ছে করে ওদের স্বাধীনভাবে। আমরা নিজস্ব আবিষ্কার চাপিয়ে দিয়ে দেই সন্তানের উপর। সমাজে হাজারো কর্মক্ষেত্র আছে যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রত্যেকটা মানুষের প্রয়োজনে আসে আর এসব কর্মক্ষেত্রে হাজারো সফল ব্যক্তি কর্ম করে সফল হয়েছেন। সৃৃষ্টির পরে কোন ব্যক্তি কর্মহীন নয়। আমরা সন্তানের একটু কম কিছুকে সহ্য করতে পারিনা, দোষ চাপাই সন্তানের উপর। এই যে দোষ চাপানোটা আমাদের একটা ট্রমা, আমাদের বাবা-মায়েরা মনে করতেন, আমি আমার সন্তানকে দেব, আমার সন্তান তার সন্তানকে দেবে, তার সন্তান তার সন্তানকে দেবে, এরকম ধারাবাহিক ভাবে দিবে বা দিতে হবে। আসলে এটা একটা স্বার্থ যা বাহ্যিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। গভীর চিন্তা এবং খুব সময় নিয়ে মননশীলতা ছাড়া আমরা কি এমন ট্রমা বা চাপ বা প্রভাব খাটানো ছাড়া আমাদের জেনারেশন কে ভালো কিছু মন মানসিকতা গড়ার উপাদান দিয়ে যেতে পারি না একটা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে যেতে পারি না? একটু নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একটা সন্তানকে বিশাল বিশাল দৃষ্টান্ত রাখার অবস্থানে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এবং ব্যক্তিগত আবিস্কার, সমাজ, জাতি, এমনকি বিশ্ববরেণ্য হিসেবে তৈরি করে দিতে পারে। সন্তানকে অন্য কারো সাথে তুলনা করে পিছিয়ে পড়া বা অবজ্ঞার চোখে দেখা যাবে না, এসব কারণগুলো একটা সন্তানকে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে গড়ে দিতে চাইলেই সন্তান মানুষ হিসেবে বা তার পরবর্তী প্রজন্ময়ের জন্য সৃষ্টিশীল কিছু দিয়ে যেতে পারবে।
প্রত্যেকটি সন্তান প্রত্যেকটি বাবা-মায়ের আদরের অমূল্য সম্পদ….