ডিজিটাল থেকে সাইবার-নতুন বোতলে পুরোনো মদ

খোন্দকার জিল্লুর রহমান :
অতিসম্প্রতি মন্ত্রিসভায় প্রণীত ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধাস্ত নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আইনটি সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের যে উদ্বেগ বা ঊৎকন্ঠা ছিল, সরকার সে সময়ে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্বেগ বা ঊৎকন্ঠা আমলে নেয়নি। সরকারকে ধ্বংস করার জন্য নীতি আদর্শ ও বিবেক বলি দেওয়া সুযোগ সন্ধানী অতি ঊৎসাহি কিছু লোক সরকারের ভিতর আরেকটা অদৃশ্য সরকার তৈরি করে নিজেদের মসনদ ঠিক রাখার জন্য এতদ সংশ্লিষ্টদের দুরে সরিয়ে রাখে। সরকারের দাবি ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জাতির প্রয়োজনে এবং দেশের নাগরিকদের স্বার্থেই করা হয়েছে, কিন্তু আইন সৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনি ও প্রশাসনের কিছু লোকের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহারের কারনে সরকারের প্রতি বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। সরকার বুঝতে পারে, শীব গড়তে গিয়ে বানর গড়ে ফেলেছে, এবং এই বানরের কারনে সরকারের মসনদ নড়বড় হওয়ার পথে, যা বহিঃবিশ্বের চাপ ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রমান পাওয়া যায়। একদিকে সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ আমলে না নিয়ে যে ভুল করেছে তার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের কথা চিন্তা না করে আবার সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের যুক্তি ও মতামত না নিয়ে ছল চাতুরতার মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে আইন করার ঘোষণা সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের বুঝার বাকি নাই। সংবাদসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেন, “ ডিজিটাল থেকে সাইবার মানে নতুন বোতলে পুরোনো মদ।” অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনস্বার্থেই এখন পরিবর্তণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাইলে ধরে নিতে হয়, সরকার প্রথমে ভূল করেছে।
এই আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি স্বাধীন মত প্রকাশের পরিপন্থী, ৪৩ ধারা অনুযায়ী, পুলিশকে বাসাবাড়ি, অফিস, দেহ, কম্পিউটার, সার্ভার, এককথায় সবকিছু জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এই ধারায় পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, বলতে গেলে ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়া সভ্যতার মাপকাঠি নয়,যা বাতিলের দাবি উঠে। তবে আগের কিছু অ-জামিনযোগ্য ধারা নতুন আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ ধারা এখনো অ-জামিনযোগ্য রয়েছে। দুয়েক ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে সাত বছর থেকে তিন বছর করা হয়েছে, এতে বৈপ্লবিক কোন পরিবর্তন মনে হয়না। মানহানির ক্ষেত্রে ডিএসএ এর ২৯ ধারায় পাঁচ বছরের কারাদন্ড বিলুপ্ত করে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে, এ টাকা দেশের কতজন মানুষের আছে? বিশেষ করে সাংবাদিক ক’জন এ সক্ষমতা রাখেন? আর এ টাকা না থাকা মানে শাস্তিভোগ, ফলে আইনটি সবক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ কম।
সর্বোপরি প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয় তাই আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মতামত প্রয়োজন। যেহেতু সরকার এই আইনটি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু এই আইনে করা মামলাগুলোও দ্রুত প্রত্যাহার এবং এই আইনে যারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কারাভোগ করেছেন, তাঁদের অতি তাড়াতাড়ি মুক্তি দেওয়া হোক।